মাসিক বা পিরিয়ড নারীদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় একটি প্রক্রিয়া। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পিরিয়ড হওয়া একজন নারীর স্বাস্থ্যের ভারসাম্য বজায় থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। তবে অনেক সময় দেখা যায়, পিরিয়ড নির্দিষ্ট সময়ে না হয়ে দেরিতে হয় বা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এটিকে আমরা বলি “অনিয়মিত পিরিয়ড” বা “Irregular Periods”। এই সমস্যাটি অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই সাধারণ হলেও, দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে এটি দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার কারণ, লক্ষণ, ঝুঁকি ও সমাধান সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার সম্ভাব্য কারণ:
অনিয়মিত পিরিয়ড হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। নিচে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো তুলে ধরা হলো:
১. হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত পিরিয়ড হয়। এই হরমোনগুলো যদি কোনো কারণে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, তাহলে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
হরমোনজনিত কিছু সাধারণ কারণ:
-
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS): ডিম্বাশয়ে একাধিক সিস্টের উপস্থিতি হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। এটি অনিয়মিত মাসিকের সবচেয়ে সাধারণ কারণ।
-
থাইরয়েড সমস্যা: হাইপারথাইরয়েডিজম বা হাইপোথাইরয়েডিজম হরমোনের গঠনকে প্রভাবিত করে।
-
প্রোল্যাক্টিনের অতিরিক্ত নিঃসরণ: মস্তিষ্কে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে প্রোল্যাক্টিন হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ পিরিয়ডে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
২. অতিরিক্ত মানসিক চাপ
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ শরীরের হাইপোথ্যালামাস নামক মস্তিষ্কের একটি অংশকে প্রভাবিত করে, যা হরমোন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে পিরিয়ড চক্রে বিঘ্ন ঘটে।
সাধারণ চাপের উৎস:
-
সম্পর্কের সমস্যা
-
পড়াশোনা বা চাকরির চাপ
-
আর্থিক অনিশ্চয়তা
-
পরিবারিক উদ্বেগ
৩. ওজন সমস্যা
অতিরিক্ত ওজন বা ওজন হ্রাস – উভয়ই পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়ার জন্য দায়ী হতে পারে।
ওজন-সম্পর্কিত কারণ:
-
স্থূলতা (Obesity): অতিরিক্ত ফ্যাট টিস্যু শরীরে ইস্ট্রোজেনের অতিরিক্ত উৎপাদন ঘটায়।
-
অতিরিক্ত ওজন হ্রাস: খাদ্যাভ্যাসে কঠোর পরিবর্তন বা খাওয়ার অভ্যাসে ব্যাঘাত শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও শক্তির অভাব তৈরি করে, যা মাসিক বন্ধ করে দিতে পারে।
৪. অতিরিক্ত শারীরিক ব্যায়াম
অতিরিক্ত ব্যায়াম বা অনুশীলন শরীরে ক্যালোরি ঘাটতি সৃষ্টি করে, যা হরমোন উৎপাদন ব্যাহত করে এবং মাসিক বন্ধ বা অনিয়মিত হতে পারে।
সাধারণ অবস্থান:
-
পেশাদার ক্রীড়াবিদ
-
যারা হঠাৎ করে অতিরিক্ত ব্যায়াম শুরু করেন
-
ক্যালোরির অভাবে দুর্বলতা ও হরমোনে প্রভাব পড়ে
৫. জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা ওষুধ গ্রহণ
বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, বিশেষ করে পিল গ্রহণ, শরীরের হরমোন চক্রে পরিবর্তন ঘটায়, যা পিরিয়ড অনিয়মিত করে তুলতে পারে।
অন্যান্য ওষুধ:
-
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট
-
কেমোথেরাপি ওষুধ
-
স্টেরয়েড
৬. বয়সজনিত পরিবর্তন
কিশোরী বয়স:
-
অনেক মেয়ের প্রথম কয়েক বছরে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়, কারণ হরমোন চক্র তখনো স্থিতিশীল হয়নি।
মেনোপজের আগে:
-
মেনোপজ শুরুর কয়েক বছর আগে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এটি একেবারে স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।
৭. ক্রনিক রোগ
কিছু দীর্ঘমেয়াদি রোগ যা পিরিয়ডকে প্রভাবিত করতে পারে:
-
ডায়াবেটিস
-
সেলিয়াক ডিজিজ
-
কিডনি রোগ
-
লিভার সমস্যা
এসব রোগ হরমোন ও পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট করে অনিয়মিত মাসিকের সৃষ্টি করে।
৮. প্রেগনেন্সি বা গর্ভধারণ
প্রেগনেন্সি হলে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। তাই অনিয়মিত পিরিয়ডের ক্ষেত্রে গর্ভধারণ পরীক্ষাও প্রয়োজন হতে পারে।
৯. স্তন্যদান
বাচ্চা জন্মের পর স্তন্যদান চলাকালীন অনেক নারীর পিরিয়ড কয়েক মাস অনিয়মিত বা বন্ধ থাকে। এটি প্রোল্যাক্টিন নামক হরমোনের কারণে হয়ে থাকে, যা দুধ উৎপাদনের জন্য দায়ী।
১০. ইউটেরাস বা ওভারির সমস্যা
কিছু শারীরিক কারণ:
-
ফাইব্রয়েড বা টিউমার: জরায়ুতে টিউমার থাকলে পিরিয়ডে ব্যাঘাত ঘটে।
-
এন্ডোমেট্রিওসিস: জরায়ুর বাইরে টিস্যু বৃদ্ধির ফলে ব্যথাযুক্ত ও অনিয়মিত মাসিক হয়।
-
অসুখ বা সংক্রমণ: পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID) এর কারণে পিরিয়ডে সমস্যা হতে পারে।
পিরিয়ড অনিয়মিতের লক্ষণ:
১. সময়ের আগে বা পরে মাসিক হওয়া
সাধারণত ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে মাসিক হওয়াকে স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি প্রতি মাসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মাসিক হয় বা অনেক দিন পর হয়, তাহলে সেটি অনিয়মিত পিরিয়ডের লক্ষণ।
২. মাসিক সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া
তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে মাসিক না হওয়া (যখন আপনি গর্ভবতী নন বা মেনোপজ হয়নি) তা অলিগোমেনোরিয়া বা অ্যামেনোরিয়া নির্দেশ করে।
৩. অতিরিক্ত রক্তপাত (Menorrhagia)
মাসিকের সময় যদি খুব বেশি রক্তপাত হয় বা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, সেটিও অনিয়মিত মাসিকের লক্ষণ।
৪. খুব অল্প রক্তপাত
যদি প্রতি মাসে মাসিক হয় ঠিকই, কিন্তু খুব কম সময় বা অল্প রক্তপাত হয়, তাও একটি লক্ষণ।
৫. মাসিকের মাঝে অনিয়মিত রক্তপাত
দুইটি মাসিকের মাঝখানে হঠাৎ রক্তপাত হওয়া বা দাগ পড়া (spotting) অনিয়মিত হরমোনের ইঙ্গিত দেয়।
৬. ব্যথাযুক্ত বা অস্বাভাবিক ব্যথা
যদি মাসিকের সময় প্রচণ্ড পেট ব্যথা, কোমর ব্যথা বা অস্বাভাবিক শারীরিক অস্বস্তি হয়, তাহলে সেটিও সমস্যা নির্দেশ করতে পারে।
৭. রক্তের রঙ বা ঘনত্বে অস্বাভাবিকতা
রক্তের রঙ অত্যধিক গাঢ় বা হালকা, এবং জমাট বেঁধে আসা রক্তের পরিমাণ বেশি হলে সেটি অস্বাভাবিক হতে পারে।
৮. হরমোনজনিত অন্যান্য লক্ষণ
-
-
মুখে বা শরীরে অতিরিক্ত লোম গজানো
-
হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস
-
ব্রণ বা ত্বকের সমস্যা
-
স্তনে ব্যথা বা ফোলা
এসব লক্ষণ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS) বা থাইরয়েড সমস্যার কারণে হতে পারে।
-
অনিয়মিত পিরিয়ডের সঠিক কারণ কীভাবে নির্ণয় করবেন:
অনিয়মিত পিরিয়ডের সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। নিচের পরীক্ষাগুলো প্রয়োজন হতে পারে:
১. স্বাস্থ্য ও মাসিক ইতিহাস বিশ্লেষণ
প্রথমেই চিকিৎসক আপনার বিস্তারিত স্বাস্থ্য ইতিহাস জানতে চান, যেমন:
-
শেষ মাসিক কবে হয়েছে?
-
মাসিক চক্রের সময়কাল কেমন?
-
রক্তপাত কতদিন থাকে এবং পরিমাণ কেমন?
-
আগে কখনো গর্ভধারণ হয়েছিল কি না?
-
কোন ওষুধ বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন কি না?
-
অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ব্যায়াম, বা ওজন পরিবর্তন হয়েছে কি না?
২. শারীরিক পরীক্ষা (Physical Examination)
চিকিৎসক আপনার ওজন, উচ্চতা, বিএমআই, ত্বক, মুখে বা শরীরে অস্বাভাবিক লোম, ব্রণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেন। এইসব লক্ষণ PCOS বা হরমোনজনিত সমস্যা নির্দেশ করতে পারে।
৩. রক্ত পরীক্ষা (Blood Tests)
নিম্নলিখিত কিছু রক্ত পরীক্ষা অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণ নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে:
-
FSH ও LH (Follicle Stimulating Hormone, Luteinizing Hormone): ডিম্বাণু তৈরির হরমোন
-
ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন লেভেল: মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন
-
টেস্টোস্টেরন: বেশি থাকলে এটি PCOS নির্দেশ করে
-
থাইরয়েড হরমোন (TSH, T3, T4): থাইরয়েড সমস্যা চিহ্নিত করতে
-
প্রোল্যাক্টিন: স্তনে দুধ তৈরিকারী হরমোন; বেশি হলে মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে
-
ডায়াবেটিস বা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স পরীক্ষাও প্রয়োজন হতে পারে
৪. আল্ট্রাসোনোগ্রাফি (Ultrasound)
পেলভিক আল্ট্রাসোনোগ্রাফি জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের গঠন নিরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে:
-
পলিসিস্টিক ওভারি (PCOS) আছে কি না
-
ফাইব্রয়েড বা টিউমার আছে কি না
-
জরায়ু বা ডিম্বাশয়ে কোনো গঠনগত সমস্যা আছে কি না
এইসব তথ্য পাওয়া যায়।
৫. ইউরিন টেস্ট বা প্রেগনেন্সি টেস্ট
অনিয়মিত পিরিয়ড হলে গর্ভধারণ হয়েছে কি না, তা যাচাই করতে প্রথমেই ইউরিন প্রেগনেন্সি টেস্ট করা হয়।
৬. এন্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসি (প্রয়োজনে)
অনেক ক্ষেত্রে জরায়ুর অভ্যন্তরীণ পর্দা (endometrium) থেকে ছোট একটি নমুনা নিয়ে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়, বিশেষ করে যদি:
-
বয়স বেশি হয়
-
রক্তপাত অস্বাভাবিক হয়
-
ক্যানসার বা ইনফেকশনের সম্ভাবনা থাকে
৭. হরমোনাল চ্যালেঞ্জ টেস্ট (Hormone Challenge Test)
চিকিৎসক প্রোজেস্টেরন বা অন্য হরমোনের মাধ্যমে শরীরের প্রতিক্রিয়া দেখে সিদ্ধান্ত নেন শরীরে কোন হরমোনের ঘাটতি রয়েছে।
চিকিৎসা ও সমাধান:
১. লাইফস্টাইল পরিবর্তন
অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মিত পিরিয়ডের মূল কারণ জীবনযাপনের সমস্যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। যেমন:
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
-
পুষ্টিকর, কম ফ্যাটযুক্ত ও প্রচুর ফলমূল-শাকসবজি খাওয়া।
-
রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (সাদা ভাত, ময়দা ইত্যাদি) কমিয়ে দেয়া।
-
পর্যাপ্ত পানি পান করা।
নিয়মিত ব্যায়াম:
-
প্রতিদিন ৩০ মিনিট হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম (যেমন brisk walking, yoga) হরমোন ব্যালেন্সে সহায়তা করে।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ:
-
মেডিটেশন, প্রার্থনা, গান শোনা, বই পড়া বা যেকোনো শখের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো।
পর্যাপ্ত ঘুম:
-
প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম।
২. ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা
সঠিক রোগ নির্ণয়ের ভিত্তিতে চিকিৎসক নিচের ধরনের ওষুধ দিতে পারেন:
হরমোন থেরাপি:
-
অ্যাস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরন যুক্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল মাসিক চক্রকে নিয়মিত করতে সাহায্য করে।
-
শুধুমাত্র প্রোজেস্টিন থেরাপিও ব্যবহৃত হয় নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে।
মেটফর্মিন (Metformin):
-
PCOS ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, যা ওভুলেশন ঠিক করতে সহায়তা করে।
ক্লোমিফেন (Clomiphene):
-
গর্ভধারণে সমস্যা থাকলে ডিম্বাণু উৎপাদন বাড়াতে ব্যবহৃত হয়।
থাইরয়েড ওষুধ:
-
যদি থাইরয়েডের সমস্যা থাকে, তবে TSH লেভেল নিয়ন্ত্রণে ওষুধ দেওয়া হয় (যেমন Thyronorm)।
প্রোল্যাক্টিন নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ:
-
প্রোল্যাক্টিন হরমোন বেশি থাকলে ব্রোমোক্রিপটিন বা ক্যাবারগোলিন ব্যবহার করা হয়।
৩. প্রাকৃতিক উপায় ও ঘরোয়া সমাধান (Home Remedies)
এসব পদ্ধতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অনুসরণ করা উচিত।
আদা:
-
মাসিক নিয়মিত করতে আদা ও মধু দিয়ে গরম পানি পান করা যেতে পারে।
তিল বীজ ও মধু:
-
সকালে এক চা চামচ তিল বীজ ও এক চামচ মধু খাওয়া যেতে পারে মাসিক নিয়ন্ত্রণে।
পুদিনা পাতা:
-
শুকনো পুদিনা গুঁড়ো করে এক চিমটি মধুর সঙ্গে খেলে হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৪. চিকিৎসা ছাড়া কবে সম্ভব নয়?
নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা প্রয়োজন:
-
PCOS, থাইরয়েড বা প্রোল্যাক্টিনের সমস্যা
-
উমের বয়সে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া (Premature Menopause)
-
ফাইব্রয়েড বা টিউমার
-
জরায়ু বা ওভারির গঠনগত ত্রুটি
-
অনিয়মিত পিরিয়ডের সঙ্গে ইনফার্টিলিটি (বন্ধ্যত্ব)
৫. নিয়মিত ফলোআপ ও মনিটরিং
-
চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট সময় অন্তর হরমোন পরীক্ষা করা।
-
আল্ট্রাসোনো বা প্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা।
-
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলে তা চিকিৎসককে জানানো।
পিরিয়ড নিয়মিত রাখতে যা করবেন:
-
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম ও খাওয়া।
-
প্রোটিন, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ও জিংকযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন।
-
সুষম ডায়েট ও পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
-
অতিরিক্ত ক্যাফেইন, জাঙ্ক ফুড ও চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
-
স্ট্রেস কমাতে ধ্যান, যোগা ও মেডিটেশন চর্চা করুন।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন:
-
যদি পরপর ৩ মাস পিরিয়ড না হয়
-
মাসিক খুব বেশি বা কম সময় স্থায়ী হয়
-
গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দেয়
-
তলপেটে তীব্র ব্যথা হয়
-
হঠাৎ করে খুব বেশি ওজন বেড়ে যায় বা কমে যায়
অনিয়মিত পিরিয়ড একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এর পেছনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই অবহেলা না করে এর সঠিক কারণ খুঁজে বের করে সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস, মানসিক শান্তি ও প্রয়োজনীয় শারীরিক সচেতনতা বজায় রাখুন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পিরিয়ড অনিয়মিত : জেনে নিন কারণ ও সমাধান – গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: মাসিক অনিয়মিত হলে কি এটা খুব গুরুতর সমস্যা?
উত্তর:
সবসময় গুরুতর নয়, তবে নিয়মিত না হলে তা শরীরে হরমোনের অসামঞ্জস্য, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS), থাইরয়েডের সমস্যা বা অন্যান্য শারীরিক জটিলতার ইঙ্গিত দিতে পারে। তাই সমস্যাটি দীর্ঘদিন থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
প্রশ্ন ২: অনিয়মিত পিরিয়ডের প্রধান কারণ কী কী?
উত্তর:
অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণ হতে পারে – মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ব্যায়াম, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, থাইরয়েডের সমস্যা, PCOS, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের প্রভাব, গর্ভধারণ, ডায়াবেটিস, কিংবা অকাল মেনোপজ।
প্রশ্ন ৩: কবে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর:
নিম্নলিখিত অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন:
-
টানা তিন মাস বা তার বেশি সময় মাসিক না হওয়া
-
এক মাসে একাধিকবার বা অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া
-
গর্ভধারণে সমস্যা হওয়া
-
হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া বা মুখে লোম দেখা দেওয়া
-
পিরিয়ড চলাকালীন অত্যধিক ব্যথা
প্রশ্ন ৪: অনিয়মিত পিরিয়ডের জন্য কী কী পরীক্ষা করতে হয়?
উত্তর:
চিকিৎসক সাধারণত নিচের পরীক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন:
-
হরমোন পরীক্ষা (FSH, LH, TSH, Prolactin, Estrogen, Testosterone)
-
আল্ট্রাসোনোগ্রাফি (ওভারি ও জরায়ু পরীক্ষা)
-
রক্তের সুগার লেভেল
-
প্রেগনেন্সি টেস্ট (প্রয়োজনে)
প্রশ্ন ৫: ওষুধ ছাড়া অনিয়মিত পিরিয়ড ঠিক করা সম্ভব?
উত্তর:
হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব। ওজন নিয়ন্ত্রণ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ কমানো, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে অনেক সময় মাসিক নিয়মিত করা সম্ভব হয়। তবে জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে।
প্রশ্ন ৬: পিরিয়ড নিয়মিত রাখতে কী খাওয়া উচিত?
উত্তর:
সুষম খাবার গ্রহণ করা উচিত – যেমন সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার (ডিম, মাছ, ডাল), বাদাম ও পর্যাপ্ত পানি। রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট, অতিরিক্ত মিষ্টি ও ফাস্ট ফুড পরিহার করা উচিত।
প্রশ্ন ৭: কীভাবে বুঝব আমার পিরিয়ড অনিয়মিত?
উত্তর:
যদি মাসিক প্রতি মাসে এক সময় না হয়, ২১ দিনের কম বা ৩৫ দিনের বেশি ব্যবধান থাকে, রক্তপাত অস্বাভাবিক হয় বা মাঝে মাঝে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তা অনিয়মিত বলে ধরা হয়।
প্রশ্ন ৮: পিরিয়ড অনিয়মিত হলে কি সন্তান নেওয়ার সমস্যা হয়?
উত্তর:
হ্যাঁ, বিশেষ করে যদি ওভুলেশন অনিয়মিত হয় (যেমন PCOS-এর ক্ষেত্রে), তবে গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসা ও পদ্ধতির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
প্রশ্ন ৯: জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বন্ধ করার পর পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়া কি স্বাভাবিক?
উত্তর:
হ্যাঁ, অনেক সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বন্ধ করার পর কয়েক মাস পর্যন্ত মাসিক চক্রে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। সাধারণত এটি কয়েক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায়, তবে দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।
প্রশ্ন ১০: অনিয়মিত পিরিয়ড দীর্ঘদিন চললে ভবিষ্যতে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর:
দীর্ঘদিন অনিয়মিত পিরিয়ড চললে বন্ধ্যত্ব, ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড, এন্ডোমেট্রিয়াল হাইপারপ্লাসিয়া বা এমনকি জরায়ুর ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাই সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
No comment yet, add your voice below!