বাংলাদেশে বর্ষাকাল একদিকে যেমন সবুজ প্রকৃতির শোভা বাড়িয়ে তোলে, অন্যদিকে তেমনি বয়ে আনে বিভিন্ন রোগব্যাধির আতঙ্ক। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ও আলোচিত রোগগুলোর একটি হলো ডেঙ্গু। প্রতিবছর বর্ষার শুরু থেকেই গণমাধ্যমে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর খবর শোনা যায়। সামান্য অসাবধানতায় এই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, এমনকি প্রাণহানির কারণও হতে পারে।
ডেঙ্গু কী:
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা ‘এডিস মশা’ (বিশেষ করে Aedes aegypti ও Aedes albopictus) এর কামড়ে ছড়ায়। এই ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছে – DEN-1, DEN-2, DEN-3 ও DEN-4। এর মধ্যে যেকোনও একটি দিয়ে আক্রান্ত হলে রোগীর শরীরে ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়। তবে পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনে আক্রান্ত হলে রোগ জটিল ও প্রাণঘাতী রূপ নিতে পারে, যেমন ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS)।
বর্ষা ও ডেঙ্গুর সম্পর্ক:
বর্ষাকালে চারদিকে পানি জমে থাকে – ড্রেন, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, পলিথিন, কনস্ট্রাকশন সাইট, এমনকি ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানি – এডিস মশা এগুলোতেই ডিম পাড়ে। এই মশার ডিম থেকে ৩–৫ দিনের মধ্যে লার্ভা হয় এবং দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়। এডিস মশা সাধারণত সকাল ও বিকেলবেলা বেশি সক্রিয় থাকে।
ডেঙ্গুর উপসর্গ;
ডেঙ্গুর উপসর্গগুলো সাধারণত ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৪–৭ দিন পর দেখা দেয়। এদের মধ্যে সাধারণ ও জটিল লক্ষণগুলো হলো:
১. হঠাৎ করে উচ্চ মাত্রার জ্বর
ডেঙ্গুর সবচেয়ে প্রথম এবং সাধারণ লক্ষণ হলো হঠাৎ করে ১০৪°F (৪০°C) বা তার চেয়েও বেশি জ্বর হওয়া। জ্বর সাধারণত দুই বা তিন দিন স্থায়ী হয়, এরপর কিছুটা কমে আবার বাড়তে পারে, যাকে “saddleback fever” বলা হয়।
২. তীব্র মাথাব্যথা
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের তীব্র মাথাব্যথা হয়ে থাকে, বিশেষত কপালের চারপাশে এবং চোখের পেছনের অংশে। এই ব্যথা অসহনীয় হতে পারে।
৩. চোখের পেছনে ব্যথা (Retro-orbital pain)
চোখ ঘোরানো বা নড়াচড়া করলে ব্যথা বেড়ে যায়। এটি ডেঙ্গুর একটি বৈশিষ্ট্যসূচক উপসর্গ।
৪. পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা (Muscle and Joint Pain)
একে “breakbone fever” বলা হয় কারণ রোগী এই ব্যথাকে এমনভাবে অনুভব করেন যেন হাড় ভেঙে যাচ্ছে।
৫. বমি ভাব ও বমি করা
অনেক সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা বমি বমি ভাব অনুভব করে এবং একাধিকবার বমি করতে পারে।
৬. চর্মরোগ বা র্যাশ (Skin Rash)
ডেঙ্গুতে ত্বকে লালচে র্যাশ হতে পারে। এটি শরীরের উপরের অংশে দেখা যায় এবং পরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক সময় র্যাশের সঙ্গে চুলকানি হয়।
৭. গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া বা লিম্ফোডেনোপ্যাথি
কিছু ক্ষেত্রে গলা ও শরীরের অন্যান্য অংশে লিম্ফ গ্ল্যান্ড (lymph node) ফুলে যেতে দেখা যায়।
৮. অবসাদ ও দুর্বলতা
জ্বর সেরে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন রোগী ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করতে পারেন।
ডেঙ্গুর জটিল ও মারাত্মক উপসর্গ:
সব ক্ষেত্রে নয়, তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জটিল রূপ ধারণ করতে পারে, একে বলা হয় “Severe Dengue” বা “Dengue Hemorrhagic Fever (DHF)” ও “Dengue Shock Syndrome (DSS)”, যা প্রাণঘাতী হতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত উপসর্গ দেখা যায়:
১. রক্তক্ষরণ (Bleeding tendency)
-
দাঁত ও মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
-
পায়খানায় কালো রক্ত
-
প্রস্রাবে রক্ত
-
ত্বকের নিচে ছোট ছোট লাল দাগ (petechiae)
-
নাক থেকে রক্ত পড়া
২. প্লেটলেট কমে যাওয়া (Thrombocytopenia)
-
রক্তের প্লেটলেট সংখ্যা খুব কমে যায়, যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
৩. পানি জমে যাওয়া (Plasma Leakage)
-
শরীরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে ফুসফুসে বা পেটে পানি দেখা যায়, যা শ্বাসকষ্ট ও পেটে ফুলাভাব সৃষ্টি করতে পারে।
৪. শক সিনড্রোম (Shock Syndrome)
-
রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে নেমে যাওয়া
-
ঠান্ডা হাত-পা, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
-
প্রস্রাব কমে যাওয়া
-
চেতনা হারানো
শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর উপসর্গ:
শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর উপসর্গ কিছুটা অস্পষ্ট ও ধীরগতিতে প্রকাশ পেতে পারে। অনেক সময় শুধু জ্বর, খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি বা অতিরিক্ত ঘুমানোর প্রবণতা দেখা যায়।
উপসর্গ শুরু হওয়ার সময়
ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে উপসর্গগুলো শুরু হতে পারে। এই সময়কে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলা হয়। উপসর্গ সাধারণত ২ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়, তবে দুর্বলতা আরো কিছুদিন থাকতে পারে।
ডেঙ্গু রোগ নির্ণয়:
১. রোগীর ইতিহাস ও উপসর্গ মূল্যায়ন
প্রথম ধাপে চিকিৎসক রোগীর জ্বরের ধরণ, অন্যান্য উপসর্গ (যেমন মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, গাঁটে ব্যথা, র্যাশ, বমি ইত্যাদি) যাচাই করেন। পাশাপাশি প্রশ্ন করা হয়—
-
জ্বর কবে থেকে হয়েছে?
-
মশার কামড় হয়েছে কি না?
-
অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কি না?
এই প্রাথমিক তথ্যগুলো রোগ নির্ণয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করে।
ল্যাব টেস্ট বা পরীক্ষাগুলো:
২. NS1 Antigen Test
-
যখন করা হয়: সাধারণত জ্বরের প্রথম ১–৫ দিনের মধ্যে
-
কী করে: ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রোটিন (NS1 অ্যান্টিজেন) শনাক্ত করে
-
উপকার: দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ফলাফল দেয়
৩. IgM এবং IgG Antibody Test (ELISA)
-
IgM: ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ৫–৭ দিন পর শরীরে তৈরি হয়
-
IgG: আগের কোনো সময় ডেঙ্গু হলে এটি পাওয়া যায়
-
ব্যবহার: বুঝতে সাহায্য করে যে রোগী নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন না পুরাতন সংক্রমণ ছিল
৪. CBC (Complete Blood Count) / রক্তের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা
ডেঙ্গু রোগীর রক্তে সাধারণত যে পরিবর্তনগুলো দেখা যায়:
-
প্লেটলেট কমে যাওয়া (Thrombocytopenia): ১ লক্ষের নিচে নেমে যেতে পারে
-
WBC (সাদা রক্তকণিকা) কমে যাওয়া
-
হেমাটোক্রিট (HCT) বৃদ্ধি: রক্তে ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ
৫. RT-PCR (Reverse Transcription Polymerase Chain Reaction)
-
উচ্চ নির্ভুলতার পরীক্ষা
-
ভাইরাসের জিনগত উপাদান শনাক্ত করে
-
বিশেষায়িত হাসপাতাল বা ল্যাবে করা হয়
-
ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন (serotype DENV-1, 2, 3, 4) পর্যন্ত নির্ধারণ করা সম্ভব
ডেঙ্গু হলে করণীয়:
ডেঙ্গুর কোনও নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। চিকিৎসা মূলত উপসর্গের ভিত্তিতে হয়:
১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন
-
শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম অত্যন্ত জরুরি।
-
ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম একেবারে নিষেধ।
২. প্রচুর পানি পান করুন
-
ডেঙ্গুতে শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায়।
-
দিনে অন্তত ৩-৪ লিটার তরল গ্রহণ করতে হবে:
পানি
ডাবের পানি
স্যুপ
ফলের রস (বিশেষত পেঁপে, মাল্টা, আপেল)
৩. পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খান
-
হালকা, সহজপাচ্য খাবার খান:
ভাত-ডাল
সেদ্ধ শাকসবজি
কলা, পেঁপে, আপেল -
তেল-ঝাল, ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন।
ওষুধ ব্যবহারে সতর্কতা:
যেগুলো ব্যবহার করা যায়
-
প্যারাসিটামল (Paracetamol): জ্বর ও ব্যথা কমাতে
➤ তবে দিনে ৩-৪ বার, সর্বোচ্চ ৪০০০ মিগ্রা পার দিনে
যেগুলো এড়িয়ে চলা উচিত
-
অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen), ডাইক্লোফেনাক:
➤ এগুলো রক্ত পাতলা করে, রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে
➤ ডেঙ্গুতে এগুলো মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে
নিয়মিত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ:
১. প্লেটলেট কাউন্ট ও হেমাটোক্রিট টেস্ট করুন
-
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন বা একদিন পরপর CBC পরীক্ষা করান।
২. জ্বরের ধরন লক্ষ্য করুন
-
জ্বর হঠাৎ কমে গেলে তা ভালো লক্ষণ হলেও, এর পরেই রক্তক্ষরণ বা শকের ঝুঁকি বাড়ে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়:
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা এবং মশাবাহিত কামড় থেকে সুরক্ষা।
১. মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করুন
-
বাড়ির ভিতর ও আশেপাশে কোথাও পানি জমে থাকতে দেবেন না, বিশেষ করে ফুলদানি, প্লাস্টিক কনটেইনার, ডাবের খোসা, টায়ার, ছাদে পানি জমে থাকা জায়গা।
-
পানির ট্যাংক, ড্রাম বা বালতি সবসময় ঢেকে রাখতে হবে।
-
সপ্তাহে অন্তত একবার এসব জায়গা পরিষ্কার করে পানি ফেলে দিন।
-
পরিত্যক্ত বোতল, কৌটা বা প্লাস্টিক সামগ্রী নষ্ট করুন বা উল্টে রাখুন যাতে পানি জমতে না পারে।
২. ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করুন
-
মশা থেকে বাঁচতে ফুলহাতা জামা ও লম্বা প্যান্ট পরুন, বিশেষ করে সকালে ও বিকেলে যখন এডিস মশা সবচেয়ে বেশি কামড়ায়।
-
ঘুমানোর সময় মশারির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করুন, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য।
-
প্রয়োজন হলে দিনে ও রাতে মশানাশক ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করুন।
-
ঘরের জানালা ও দরজায় জাল ব্যবহার করুন যেন মশা ঢুকতে না পারে।
৩. পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
-
বাড়ির আশপাশ ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার রাখুন।
-
জলাবদ্ধতা রোধে ড্রেন পরিষ্কার রাখুন যাতে পানি জমে না থাকে।
-
এলাকাবাসীর সঙ্গে মিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালান।
4. সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলুন
-
স্থানীয় প্রশাসন বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বিরোধী ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করুন।
-
প্রতিবেশীদের সচেতন করুন মশার উৎস ধ্বংস করার বিষয়ে।
-
স্কুল, অফিস ও সমাজে ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ক আলোচনার আয়োজন করুন।
৫. লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করুন
-
হঠাৎ জ্বর, মাথাব্যথা বা গাঁটে ব্যথা হলে দেরি না করে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করান।
-
নিজে ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণে সচেতন থাকুন।
সামাজিক সচেতনতা ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা:
ডেঙ্গু মোকাবিলায় শুধু ব্যক্তিগত সচেতনতা যথেষ্ট নয়, চাই সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ:
-
পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে নিয়মিত ফগিং ও লার্ভা ধ্বংস অভিযান চালাতে হবে
-
স্কুল, কলেজ, মসজিদ, বাজার – সকল স্থানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো প্রয়োজন
-
গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়াতে হবে
-
স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে পাড়া-মহল্লায় মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে
ডেঙ্গু ও করোনা: দ্বৈত হুমকি:
গত কয়েক বছরে দেখা গেছে যে করোনা মহামারির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডেঙ্গুর প্রভাবও বেড়েছে। দুই রোগের উপসর্গ প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় অনেকেই বিভ্রান্ত হন। তাই উপসর্গ দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীর ঝুঁকি:
১. শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি
কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
-
শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনও পুরোপুরি বিকশিত হয়নি।
-
তারা নিজের সমস্যাগুলো স্পষ্ট করে বোঝাতে পারে না।
-
পানি শূন্যতা ও শক সিনড্রোম দ্রুত দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ
-
কেবলমাত্র জ্বর নয়, শিশুরা কাঁদতে পারে, খেতে না চাইতে পারে, অতিরিক্ত ঘুমাতে পারে বা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
-
অনেক সময় শরীরের র্যাশ, চোখের পেছনে ব্যথা বা ঘন ঘন বমি হতে পারে।
করণীয়
-
শিশুর শরীরে কোনো অসাধারণ উপসর্গ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
-
পর্যাপ্ত তরল, বিশ্রাম ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জরুরি।
-
শিশুদের মশারির মধ্যে রাখা এবং ফুলহাতা কাপড় পরানো উচিত।
২. বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি
কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
-
বার্ধক্যে শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং অনেক সময় একাধিক দীর্ঘমেয়াদি রোগ (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ) থাকে।
-
এই রোগগুলো ডেঙ্গুর জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
লক্ষণ
-
তীব্র দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, খাওয়ায় অনীহা, অতিরিক্ত ঘুমানো, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
-
অনেক সময় রক্তচাপ হঠাৎ কমে গিয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দিতে পারে।
করণীয়
-
হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পর্যবেক্ষণে থাকা শ্রেয়।
-
নিয়মিত প্লেটলেট কাউন্ট ও শরীরের জলীয় অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৩. গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি
কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
-
গর্ভাবস্থায় শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিছুটা দুর্বল থাকে।
-
গর্ভের শিশুর উপরও ডেঙ্গুর প্রভাব পড়তে পারে।
-
কিছু ক্ষেত্রে মায়ের শরীর থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস গর্ভস্থ শিশুর শরীরে সংক্রমিত হতে পারে (vertical transmission)।
ডেঙ্গু ঠেকাতে প্রয়োজন জাতীয় পরিকল্পনা:
ডেঙ্গু এখন আর শুধু একটি মৌসুমী সমস্যা নয়, বরং এটি একটি জাতীয় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। তাই সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কয়েকটি সম্ভাব্য উদ্যোগ:
-
জাতীয় পর্যায়ে ডেঙ্গু মনিটরিং সেল গঠন
-
স্বাস্থ্যকর্মীদের ট্রেনিং
-
জরুরি প্লাটফর্ম হেল্পলাইন চালু
-
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ
-
স্কুলে সচেতনতামূলক ক্লাস ও কুইজ আয়োজন
বর্ষা মানেই প্রকৃতির আনন্দ হলেও, এই মৌসুম আমাদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে আতঙ্ক নয়, চাই প্রস্তুতি ও সচেতনতা। নিজের বাড়ি, অফিস, এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখুন, মশার প্রজনন ঠেকান, উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসা নিন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বর্ষা মানেই ডেঙ্গুর ভয়: জেনে নিন বাঁচার উপায় (FAQ)
প্রশ্ন ১: ডেঙ্গু কীভাবে ছড়ায়?
উত্তর:
ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস ইজিপ্টাই (Aedes aegypti) নামক মশার কামড়ে। এই মশাটি সাধারণত দিনের বেলা সক্রিয় থাকে, বিশেষত ভোর ও বিকেলে। যদি এ মশা কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায়, তাহলে সেই ভাইরাস সে বহন করে এবং অন্যকে কামড় দিয়ে সংক্রমণ ঘটায়।
প্রশ্ন ২: বর্ষায় ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি কেন?
উত্তর:
বর্ষায় চারদিকে পানি জমে থাকে, যা এডিস মশার প্রজননের উপযুক্ত স্থান। যেমন—ফুলদানি, টায়ার, প্লাস্টিক পাত্র, কনটেইনার ইত্যাদি। ফলে মশার সংখ্যা বেড়ে যায় এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণও ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশ্ন ৩: ডেঙ্গুর প্রধান উপসর্গ কী কী?
উত্তর:
-
হঠাৎ জ্বর
-
মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা
-
মাংসপেশি ও হাড়ে ব্যথা
-
শরীরে লাল দানা/র্যাশ
-
বমি ভাব বা বমি
-
দুর্বলতা
-
মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্তপাত (জটিল ক্ষেত্রে)
প্রশ্ন ৪: ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী কী করা উচিত?
উত্তর:
-
বাড়ির আশেপাশে কোথাও পানি জমতে দেবেন না
-
মশারির ব্যবহার করুন
-
ফুলহাতা জামা পরুন
-
মশা তাড়ানোর স্প্রে বা ক্রিম ব্যবহার করুন
-
প্রতি সপ্তাহে ডাবের খোসা, পাত্র, ড্রাম ইত্যাদি পরিষ্কার করুন
প্রশ্ন ৫: ডেঙ্গু হলে কী করবেন?
উত্তর:
-
প্রচুর বিশ্রাম নিন
-
পর্যাপ্ত পানি ও তরল গ্রহণ করুন
-
প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ব্যথানাশক খাবেন না
-
নিয়মিত CBC রিপোর্ট ও প্লেটলেট পরীক্ষা করান
-
রক্তক্ষরণ, শ্বাসকষ্ট বা অবচেতন হলে দ্রুত হাসপাতালে যান
প্রশ্ন ৬: ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ?
উত্তর:
না, ডেঙ্গু এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে ছড়ায় না। এটি শুধুমাত্র মশার মাধ্যমে ছড়ায়।
প্রশ্ন ৭: কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে?
উত্তর:
-
শিশু
-
বৃদ্ধ
-
গর্ভবতী নারী
-
যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছিল
-
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম
প্রশ্ন ৮: পেঁপে পাতার রস কি প্লেটলেট বাড়ায়?
উত্তর:
এ নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সুনির্দিষ্টভাবে নেই। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত নয়।
প্রশ্ন ৯: প্লেটলেট কমে গেলে কি রক্ত দিতে হয়?
উত্তর:
সবসময় নয়। অনেক রোগী প্লেটলেট কমেও সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু যদি রক্তক্ষরণ শুরু হয় বা প্লেটলেট বিপজ্জনকভাবে (২০,০০০-এর নিচে) কমে যায়, তখন রক্ত বা প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন প্রয়োজন হতে পারে।
প্রশ্ন ১০: ডেঙ্গুর কোনো টিকা (vaccine) আছে কি?
উত্তর:
কিছু দেশে সীমিতভাবে ডেঙ্গু টিকা (যেমন: Dengvaxia) ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে বাংলাদেশে এখনো এটি সর্বজনীনভাবে অনুমোদিত নয়। সুতরাং প্রতিরোধই সেরা উপায়।
No comment yet, add your voice below!