স্বাস্থ্য এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতার উপর নির্ভর করে। তবে আমাদের সমাজে অনেক স্বাস্থ্যবিষয়ক কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে, যা মানুষের জীবনযাত্রা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কুসংস্কারগুলি বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের অসচেতনতা ও ভুল ধারণার ফল। এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব কিভাবে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কুসংস্কার গড়ে ওঠে, এর প্রভাব এবং কিভাবে এসব দূর করা যায়।
কুসংস্কার কী এবং কীভাবে এটি গড়ে ওঠে?
কুসংস্কার বলতে সাধারণত এমন কিছু বিশ্বাস বা আচরণকে বোঝায়, যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, কিন্তু মানুষ তা সঠিক মনে করে পালন করে থাকে। এটি মূলত ভ্রান্ত ধারণা, সামাজিক রীতি, এবং শিক্ষার অভাবের কারণে গড়ে ওঠে। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কুসংস্কারের ধরণ আলাদা হতে পারে, তবে সবার উদ্দেশ্য সাধারণত একই—অজানা বিষয় থেকে সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা লাভ করা।
স্বাস্থ্যের উপর প্রচলিত কুসংস্কারের উদাহরণ
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রচলিত কুসংস্কারগুলো শুধু ভুল ধারণা নয়, এগুলো সরাসরি আমাদের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের দেশে প্রচলিত কিছু উল্লেখযোগ্য কুসংস্কার নিচে দেওয়া হলো—
- গর্ভাবস্থার সময় প্রচলিত কুসংস্কার:
- গর্ভবতী নারীর চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের সময় বাইরে বের হওয়া নিষেধ, কারণ এতে শিশুর ক্ষতি হতে পারে বলে ধারণা।
- গর্ভাবস্থায় বেশি পরিমাণে খাবার খেতে নিষেধ করা হয়, যেন গর্ভের শিশু বড় না হয়।
- গর্ভবতী মায়ের শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন অযৌক্তিক বিশ্বাস প্রচলিত, যেমন – পেটের আকৃতি দেখে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের চেষ্টা।
- শিশুর জন্ম ও লালন-পালন সংক্রান্ত কুসংস্কার:
- নবজাতক শিশুকে কাজল পরিয়ে রাখা হয়, যাতে শিশুর “নজর না লাগে”।
- শিশুর প্রথম চুল বা নখ কাটার সময় কিছু নির্দিষ্ট তারিখ বেছে নেওয়া হয়।
- শিশুকে তেল মেখে রোদে বসানো হয়, যাতে সে শক্তিশালী হয়—যা আসলে শিশুর ত্বকের ক্ষতি করতে পারে।
- মহিলাদের স্বাস্থ্যের সাথে যুক্ত কুসংস্কার:
- ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের “অশুদ্ধ” বলা হয় এবং তাদের ধর্মীয় কাজ থেকে দূরে রাখা হয়।
- এই সময়ে মেয়েদের রান্নাঘরে প্রবেশ নিষেধ এবং অনেক ক্ষেত্রে খাবার তৈরিতে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না।
- গর্ভধারণে সমস্যা হলে মহিলাদের দোষারোপ করা এবং তাদের উপর বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান চাপিয়ে দেওয়া হয়।
- রোগ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রচলিত কুসংস্কার:
- জ্বর বা অন্যান্য রোগ হলে প্রথমেই ডাক্তার না দেখিয়ে বিভিন্ন ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজের আশ্রয় নেওয়া হয়।
- “তেল-পড়া” বা “পানি-পড়া” খাওয়ানো হয় রোগের উপশমের জন্য।
- গর্ভবতী নারীদের প্রচণ্ড মাথাব্যথা বা অন্যান্য সমস্যা হলে এটিকে ‘ভূতের আছর’ বলে মনে করা হয় এবং চিকিৎসার পরিবর্তে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
- মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে প্রচলিত কুসংস্কার:
- মানসিক রোগকে “পাগলামি” বলে মনে করা হয় এবং রোগীকে চিকিৎসার বদলে সমাজ থেকে দূরে রাখা হয়।
- মানসিক রোগ হলে সাধারণভাবে এটি অপদেবতার প্রভাব বলে মনে করা হয়।
- ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, বা প্যানিক অ্যাটাকের মতো সমস্যা গুলোকে “দুর্বল মানসিকতা” হিসেবে দেখা হয়, যার ফলে রোগী সঠিক চিকিৎসা ও সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয়।
- খাবার ও পানীয় নিয়ে কুসংস্কার:
- কিছু অঞ্চলে ডিম খেলে শিশুরা “কাঠিন্যপূর্ণ” হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়।
- গর্ভবতী নারীদের মাছ বা মাংস খেতে নিষেধ করা হয়, কারণ এতে শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
- কিছু নির্দিষ্ট খাদ্য যেমন – পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদিকে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
- শরীরের গঠন ও দৈহিক স্বাস্থ্য নিয়ে কুসংস্কার:
- কিছু এলাকায় এখনও বিশ্বাস করা হয় যে, মোটা হওয়া মানেই স্বাস্থ্যবান হওয়া।
- রোগা ব্যক্তিকে সবসময় অপুষ্ট বলে ধরে নেওয়া হয়।
- উচ্চতা, ওজন, এবং শারীরিক কাঠামো নিয়ে ভিত্তিহীন ধারণা এবং সমালোচনা করা হয়।
কুসংস্কারের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নেতিবাচক প্রভাব
স্বাস্থ্যবিষয়ক কুসংস্কার শুধু ভ্রান্ত ধারণাই তৈরি করে না, এর ফলে মানুষের শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নিচে এসব কুসংস্কারের কিছু ক্ষতিকর প্রভাব উল্লেখ করা হলো—
- চিকিৎসা গ্রহণে বিলম্ব:
- প্রচলিত কুসংস্কারের কারণে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা হয় না। ফলে রোগ আরও জটিল আকার ধারণ করে।
- “ঝাড়ফুঁক” বা “তাবিজ” ব্যবহার করে চিকিৎসা বিলম্বিত করা হয়, যা রোগীর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়।
- সঠিক পুষ্টির অভাব:
- গর্ভবতী মহিলাদের অনেক ধরনের পুষ্টিকর খাবার যেমন – মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি খেতে নিষেধ করা হয়, যা তাদের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি তৈরি করে।
- শিশুর খাওয়ার ক্ষেত্রে কুসংস্কার মেনে তাকে সঠিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত করা হয়, যেমন – নবজাতককে শুধুমাত্র মধু বা চিনি খাওয়ানো।
- রোগ নির্ণয়ে সমস্যাগুলি:
- মানসিক রোগকে স্বীকার না করা বা “অপদেবতার প্রভাব” হিসেবে দেখা রোগ নির্ণয়ে জটিলতা তৈরি করে।
- অনেক সময় রোগীর আসল সমস্যার পরিবর্তে কুসংস্কারের উপর নির্ভর করে ভুল চিকিৎসা দেওয়া হয়।
- শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার:
- কিছু এলাকায় রোগের উপশমের জন্য মানুষকে “দেবতা বা ভুতের হাত থেকে মুক্তি” দেওয়ার নামে শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
- মানসিক রোগের ক্ষেত্রে রোগীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা, পিটিয়ে “ভূত তাড়ানো” ইত্যাদি বর্বর আচরণ করা হয়।
- সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি:
- মহিলাদের ঋতুস্রাবের সময় যে সমস্ত বিধিনিষেধ পালন করা হয়, তাতে তারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করে।
- কুসংস্কারজনিত কারণে অনেক পরিবারে মতবিরোধ, ঝগড়া, এবং পারিবারিক ভাঙনের সৃষ্টি হয়।
- আর্থিক ক্ষতি:
- কুসংস্কার পালনের জন্য অনেক সময় পরিবারগুলি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন, তাবিজ-কবজ বা ঝাড়ফুঁকের পিছনে অর্থ ব্যয়।
- সঠিক চিকিৎসার পরিবর্তে কুসংস্কার মেনে রোগের চিকিৎসায় অপ্রয়োজনীয় খরচ বেড়ে যায়।
- সামাজিক অবহেলা ও কলঙ্ক:
- মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে “অশুভ” বা “অপদেবতার প্রভাবিত” বলে মনে করা হয় এবং সমাজ থেকে দূরে রাখা হয়, যা তাদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে।
এইসব কুসংস্কার দূর করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা, সঠিক শিক্ষা এবং আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের মাঝে সঠিক ধারণা গড়ে তোলা। যদি সমাজের সবাই একত্রে সচেতন হয়, তাহলে এসব কুসংস্কার দূর করা সম্ভব।
উপসংহার: সুস্থ সমাজ গড়তে কুসংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি
স্বাস্থ্যবিষয়ক কুসংস্কার দূর করতে হলে আমাদের সমাজে শিক্ষার প্রসার এবং সচেতনতার প্রচারণা বাড়াতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে সচেতনতা গড়ে তোলা ছাড়া কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই আসুন, আমরা সকলে মিলে একটি কুসংস্কারমুক্ত, সুস্থ ও সচেতন সমাজ গড়ে তুলি।
No comment yet, add your voice below!